১৯৩৩ সালের জার্মানিতে নাৎসিরা যেভাবে ক্ষমতায় এসেছিল

Spread the freedom

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব জার্মানির শেষ ফ্রি এন্ড ফেয়ার ফেডারেল ইলেকশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩২ সালের ৬ নভেম্বর।

রাইখস্টাগ (জাতীয় সংসদ) -এর মোট আসন সংখ্যা ছিল ৫৮৪টি, সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে প্রয়োজন ছিল ২৯৩টি আসন জেতা।

কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নাই।

ফল —

নাৎসি পার্টি (এনএসডিএপি): ১৯৬
সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি): ১২১
কমিউনিস্ট পার্টি (কেপিডি): ১০০
সেন্টার পার্টি (যেন্ট্রাম): ৭০
জার্মান ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (ডিএনভিপি): ৫১
বাভারিয়ান পিপলস পার্টি (বিভিপি): ২০
জার্মান পিপলস পার্টি (ডিভিপি): ১১

বাকি আসনগুলো কয়েকটি ছোট দল মিলে পেয়েছিল।

নাৎসিরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সমর্থ হয় নাই।

দেশটির মূলধারার জাতীয়তাবাদী ও মধ্য-ডানপন্থী দলগুলাও তাদের সাথে কোয়ালিশন ফর্ম করে সরকার গঠন করতে রাজি হয় নাই।

ঝামেলা হচ্ছে, সেই সময়কার বামদের দুইটা দল এসপিডি আর কেপিডি একটা বামপন্থী কোয়ালিশন ফর্ম করলেও তাতে কোন নির্বাচনী লাভ হত না।

কারণ সেক্ষেত্রে বাম দলগুলোর সম্মিলিত আসন সংখ্যা ২২১, যা সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় আসন সংখ্যা ২৯৩ থেকে কম।

অন্য দিকে নাৎসিরা ছাড়া বাকি সব জাতীয়তাবাদী ও মধ্য-ডানপন্থী দল একটা মূলধারার ডানপন্থী কোয়ালিশন ফর্ম গঠন করলে তাতেও কোন নির্বাচনী লাভ হত না।

কারণ সেক্ষেত্রেও জাতীয়তাবাদী ও মধ্য-ডানপন্থীদের সম্মিলিত আসন সংখ্যা সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় আসন সংখ্যা ২৯৩ থেকে কমই হত।

ফলে, তৈরি হয় এক অদ্ভুত শাসনতান্ত্রিক সংকট।

১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে চ্যান্সেলরের পদ থেকে ইস্তফা দেন ফন পাপেন, তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল ফন শ্লাইখার।

কিন্তু শ্লাইখার-এর সামনে একটা বড় বাধা ছিল।

প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ আর তার উপদেষ্টারা চাচ্ছিলেন, রাইখস্টাগ-এর মতামতের তোয়াক্কা না করে সরাসরি চ্যান্সেলর নিয়োগ দিয়ে দেশ চালাতে। তাদের প্রয়োজন ছিল একজন পুতুল চ্যান্সেলর, যাকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট শাসন করবেন। শ্লাইখার সেই পুতুল হতে রাজি ছিলেন না।

এখন, একদিকে রাইখস্টাগ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের রাজি না করিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল রুলের জন্য হিন্ডেনবার্গের খায়েশ মিটাতে গেলে দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

অন্যদিকে, রাইখস্টাগ নিজেই নিজেকে বিলুপ্ত করে দিতে কেন রাজি হবে, সেই প্রশ্নের কোন যুক্তিসঙ্গত জবাব ছিল না।

ডিসেম্বরে শ্লাইখার ভাইস-চ্যান্সেলরের পদটা অফার করেন গ্রেগর স্ট্রাসারকে। স্ট্রাসার ছিলেন নাৎসি পার্টির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা। অস্ট্রীয় চিত্রকর তাঁকে সরকারে যোগ দেয়ার অনুমতি না দেয়ায় যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তার জের ধরে পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন স্ট্রাসার।

ফলে, শ্লাইখার-এর সামনে দেশ চালানোর জন্য প্রেসিডেন্টের জারি করা ডিক্রির ওপর নির্ভর করা ছাড়া, আর কোন উপায় খোলা ছিল না।

কিন্তু, শ্লাইখার এসময় দ্রুত আস্থা হারিয়ে ফেলছিলেন এমন দুটি শক্তির, সেদিনের জার্মানিতে যাদের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় থাকা সম্ভব ছিল না —

১) প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ: কারণ তার বন্ধু পাপেনকে পদত্যাগে বাধ্য করে চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য তিনি শ্লাইখার-এর ওপর নাখোশ ছিলেন।

২) জার্মান সেনাবাহিনী: কারণ তাদের ভয় ছিল, রাইখস্টাগ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ওপর দৃঢ় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারবেন এমন একজন চ্যান্সেলর খুঁজে পাওয়া না গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

শ্লাইখার একটা শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের কাছে একটা দরখাস্ত করেন। চ্যান্সেলরকে ব্যাপকভিত্তিক জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতা দেয়ার জন্য। যার বলে রাইখস্টাগ ভেঙে দিয়ে ১৯৩৩ সালে নতুন করে নির্বাচন আয়োজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করে দেশ চালানো যাবে।

হিন্ডেনবার্গ শ্লাইখার-এর দরখাস্ত শুনলে ইতিহাস অন্যরকম হত।

কিন্তু হিন্ডেনবার্গ শ্লাইখার-এর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তার পুরনো বন্ধু ফন পাপেনের খুব ভিন্ন একটা দরখাস্ত শুনলেন।

সেটা হল, অস্ট্রীয় চিত্রকরকে চ্যান্সেলর নিয়োগ দেয়া!

পাপেনের পরিকল্পনা ছিল, যেহেতু তারা চিত্রকরকে ভিয়েনার রাস্তার পাগল ভাবতেন, তাই তাকে পুতুল হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন।

জার্মান সেনাবাহিনীও মেনে নিয়েছিল এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, কারণ তারা ভাবছিল, এতে করে জার্মানি পাবে একটা স্থিতিশীল সরকার।

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি পাপেন-হিন্ডেনবার্গ গং সেনাসমর্থনে নাৎসি পার্টি প্রধান অস্ট্রীয় চিত্রকরকে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দেন।

১৯৩৩ সালের ২৩ মার্চ নাৎসি-নিয়ন্ত্রিত নতুন রাইখস্টাগ-এ ‘এনাবলিং এক্ট’ নামে পরিচিতি পাওয়া একটি আইন জারি করা হয়। এই আইন অস্ট্রীয় চিত্রকরকে চ্যান্সেলর হিসাবে চার বছরের জন্য বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। যা তাকে রাইখস্টাগ বা প্রেসিডেন্টের সাথে কোনরকম বোঝাপড়া ছাড়াই শাসন করার সুযোগ দেয়।

এই আইন পাশ হওয়ার জন্য রাইখস্টাগ-এর সদস্যদের যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের প্রয়োজন ছিল, তা অবশ্য তখনো নাৎসি পার্টির ছিল না।

তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে ক্যাথলিকদের সেন্টার পার্টি।

ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আইনটি পাশ হয়ে যায়।

২১ জুন নিষিদ্ধ হয় সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি)।

১ জুলাই রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে নাৎসিরা একটা বোঝাপড়ায় আসে, যাতে সরকারের তরফে জার্মান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়ার ওয়াদা করা হয়। শুধু তাই নয়, জার্মানির সরকার ও সমাজে ক্যাথলিকদের পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকারও নিশ্চয়তাও নাৎসিদের তরফে দেয়া হয়। এসব সুযোগসুবিধার বিনিময়ে ৫ জুলাই জার্মান ক্যাথলিকদের সেন্টার পার্টি বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।

১৯৩৩ সালের ১৪ জুলাই অস্ট্রীয় চিত্রকরের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার আইন তৈরি করে নাৎসি পার্টিকে জার্মানির একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল বলে ঘোষণা করে, এবং পুরনো রাজনৈতিক দল টিকিয়ে রাখা বা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিধিবদ্ধ করে।

একইদিনে কমিউনিস্ট পার্টিকে (কেপিডি) আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়, যা ছিল জার্মান বাম দলগুলোর কফিনে ঠোকা শেষ পেরেক।

জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি একদলীয় একনায়কতন্ত্রে পরিণত হল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের আগ পর্যন্ত যারা এককভাবে দেশটিকে শাসন করেছে। কীভাবে করেছে, সেই ইতিহাস অপেক্ষাকৃত বেশি পরিচিত।

তথ্যসূত্র:

  1. Wikimedia Foundation. 2024. “November 1932 German federal election.” Last modified December 06, at 8:27 (UTC). https://en.m.wikipedia.org/wiki/November_1932_German_federal_election
  2. Whittock, Martyn. 2011. A Brief History of the Third Reich. London: Constable & Robinson. p. 23-58.


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *