জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে কেমন সংস্কৃতি চাই?

Spread the freedom

১.

বিপ্লব শব্দটির সাথে আমাদের পরিচয় নতুন নয়। ‘ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)’, ‘আমেরিকান বিপ্লব (১৭৭৫-১৭৮৩)’, ‘রুশ বিপ্লব (১৯১৭)’, ‘চীনা বিপ্লব (১৯১১-১৯৪৯)’, ‘কিউবার বিপ্লব (১৯৫৩-১৯৫৯)’, ‘ইরানি বিপ্লব (১৯৭৯)’ – এ কথাগুলো বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক মহল থেকে জনপরিসর সর্বত্রই উচ্চারিত হয়। মোদ্দা কথা, বড় মাপের রাজনৈতিক পরিবর্তন বুঝাতে বাংলা ভাষায় বিপ্লব শব্দটি বহুল ব্যবহৃত।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ বা জনযুদ্ধ যেটাই বলি; সেটা কি বিপ্লব ছিল? সলিমুল্লাহ খান (বাংলাদেশী চিন্তাবিদ ও লেখক, ১৯৫৮-) মনে করেন- বিপ্লব একটা হয়েছিল বটে, কিন্তু তা বেহাত হয়ে গিয়েছে (সূত্র-“বেহাত বিপ্লব ১৯৭১”) । শ্রীনাথ রাঘবন (ভারতীয় ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ, ১৯৭৭-) অবশ্য ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি’ হিসাবে দেখেছেন, জোর দিয়েছেন পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতার বৈশ্বিক দিকটির ওপর (সূত্র- ” ১৯৭১ : বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস “) ।

সম্প্রতি বাংলাদেশে বিপ্লব শব্দটি নতুনভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে লড়াকু ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট, মতান্তরে ৩৬ জুলাই-তে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের কারণে শব্দটির এই নয়া ব্যবহার। উক্ত গণঅভ্যুত্থানে ১৫০০ -এর বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন, আর আহত হয়েছেন ৩১ হাজারের বেশি ছাত্রজনতা (সূত্র- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ-কমিটি, সেপ্টেম্বর ২০২৪ )।

জুলাই কি বিপ্লব? গণঅভ্যুত্থান? না স্রেফ আন্দোলন?

এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।

বর্তমান রচনার লেখক মনে করেন, জুলাই মাসে কোন বিপ্লব হয়নি, তবে একটা অত্যন্ত বড় মাপের আন্দোলন হয়েছে যা ‘৬৯ আর ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা বহন করে। তাই জুলাইকে গণঅভ্যুত্থান হিসেবে অভিহিত করাটাই যৌক্তিক।

এই রচনার উদ্দেশ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জন-আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দেয়া, কেমন সংস্কৃতি চাই তার একটা আভাস দেয়া।

২.

সংস্কৃতি শব্দটা বাংলা ভাষায় বহু অর্থে ব্যবহৃত।

একটা ব্যবহার দেখি বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, আর প্রত্নতাত্ত্বিকদের রচনায়; যেখানে সংস্কৃতি বলতে আসলে কোন সভ্যতার বিকাশের স্তর বুঝায়। উদাহরণস্বরূপ, নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি (Neolithic culture)। তবে সংস্কৃতি শব্দের এহেন ব্যবহার বিদ্যায়তনিক মহলেই সীমিত।

সাধারণ লোকে সংস্কৃতি বলতে শিল্পসাহিত্য চর্চা বুঝে। সেটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত উদ্যোগে সমাজের নিচুতলা পর্যন্ত যেকোন পরিসরেই চর্চিত হতে পারে। অর্থাৎ শিল্পকলা একাডেমি থেকে বাউল-ফকিরদের মাজার, সর্বত্রই। এর বাইরে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে একটা বর্গ আছে, যা মূলত রাজনীতিকদের কাছে কাম্য আচরণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার ‘হিন্দু সংস্কৃতি’, ‘মুসলিম সংস্কৃতি’, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ ইত্যাদি বর্গ ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্যিক রীতিরেওয়াজকে নির্দেশ করতে। বর্তমান রচনায় সংস্কৃতি শব্দটি সাধারণ লোকে যে অর্থে ব্যবহার করে — শিল্পসাহিত্য চর্চা — সে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

৩.

গণঅভ্যুত্থানের আগের বাংলাদেশে দেড় যুগ ধরে আর সবকিছুর মত সংস্কৃতি চর্চাও একটা বিশেষ মতাদর্শ অনুসরণ করেছে, যা ছিল সেই সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ সরকারের নেত্রী ও গণঅভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচারী হুকুমতের প্রধান শেখ হাসিনার অঘোষিত ও শেখ মুজিব আমলের ঘোষিত বাকশালী মতাদর্শ। ফলে, এই সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে ধরণের সংস্কৃতি চর্চিত হয়েছে, তাতে ‘সেক্যুলারিজম’ আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ জজবা বেশ প্রবলভাবেই চোখে পড়ে।

এর বিপরীতে ক্ষীণ একটি ধারা ছিল, যা মোটা দাগে মুসলিম পরিচয়কেন্দ্রিকই থেকেছে।

সমাজের নিচুতলার মানুষ এই দুই ধারার বাইরে নিজেদের মত করে সংস্কৃতি চর্চা করেছেন, যা সামান্যই প্রচার পেয়েছে। তবে শেষোক্তদের মধ্যে মাজারকেন্দ্রিক সংস্কৃতির চর্চা করতেন মূলত মেহনতি মানুষ, যাদের নেতৃস্থানীয়রা বাংলাদেশের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের দ্বন্দ্বের জটিল মেরুকরণের কারণে সেই সময়ের স্বৈরাচারী আওয়ামি লীগ সরকারের সাথে এক ধরণের আপোস করেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন।

৩৬ জুলাইয়ের পর মাজারে হামলার অতীব দুঃখজনক যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মূল দায় অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা হলেও এই মাদ্রাসাকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর সাথে মাজারকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক দ্বন্দ্বের দিকটিও মাথায় রাখতে হবে।

৪.

২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পরে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন অবশ্য লক্ষ্য করা যায়, যা গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশেও চলমান আছে।

‘বাঙালি মানেই হিন্দুয়ানি’ ধরে নিয়ে সংস্কৃতি চর্চায় মুসলিম পরিচয়কেন্দ্রিক ভাব, ভাষা, ভঙ্গি নিয়ে যে বিদ্বেষ ও সন্দেহ উপনিবেশিক আমল থেকেই চালু ছিল, তার প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে, অন্তত বাংলা ভাষা-কেন্দ্রিক বাংলাদেশি সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালি পরিচয় ও মুসলিম পরিচয়ের সমন্বয়ের একটা স্বাস্থ্যকর চর্চা লক্ষ্যনীয়।আবার এই একই সময়ে অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে, মাদ্রাসাকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর একাংশের ব্যাপক মাত্রায় ব্রতী হওয়াটা, মাদ্রাসা নিয়ে কিছু চালু ধারণাকে ইতিবাচকভাবে সমস্যায়িত করেছে।

এগুলো ভালো লক্ষণ।

কিন্তু বাংলাদেশ যেমন শুধুমাত্র বাঙালির দেশ নয়, তেমনি যান্ত্রিকভাবে হিন্দু মুসলমানে বিভক্তও নয়। ‘অন্যরা’ আছেন, যাদের নিয়েও কথা বলা দরকার।

৫.

এই ‘অন্যরা’ কারা?

আমার মতে, তিনটা বর্গ ভাবা যেতে পারে:

১) অবাঙালি/বিহারি/উর্দুভাষী হিসাবে পরিচিত উর্দু জবানের মানুষেরা।

২) মধুপুর অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষেরা।

৩) চা বাগানের মানুষেরা।

বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস পড়লে বা নাটক-সিনেমা দেখলে মনে হবে এই দেশে শুধু বাঙালিরাই থাকে। তারাও আবার সরলভাবে হিন্দু আর মুসলমানে বিভক্ত। বাংলাদেশের সামাজিক বৈচিত্র‍্যের প্রতিফলন ‘অন্যরা’ সামান্যই আছেন। আবার যেটুকু আছেন, সেটাও খুবই সমস্যাজনক উপায়ে।

আদিবাসীদের ‘ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান করার’ সবক দিয়ে যখন বিজ্ঞাপন বানানো হয়, সবকটা যে বাঙালিদের উদ্দেশ্যে দেয়া হচ্ছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। জনপ্রিয় নির্মাণে অবাঙালি/বিহারি/উর্দুভাষী চরিত্র আসে ‘ক্রিমিনাল’ হিসাবে, যেন বিহারি ক্যাম্পের মানুষের জীবনে আর কোন সুখ দুঃখের গল্প নাই। চা বাগান আসে ‘রোমান্টিক’ নির্মাণের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে, চা শ্রমিকদের অর্ধাহারে অনাহারে না থাকা জীবন আড়ালেই রয়ে যায়।

সংস্কৃতি চর্চায় মূলধারায়, এই ‘অন্য’-দের অর্থবহভাবে যুক্ত করতে না পারলে, সংস্কৃতি চর্চা ভরপেট মানুষদের তামাশাই রয়ে যাবে। ৩৬ জুলাই-এর পরে এই বাস্তবতার সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে।

৬.

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ কেমন সংস্কৃতি চাই?

যে সংস্কৃতি বাংলাদেশ নিয়ে কোন বিশেষ মতাদর্শিক লাইনে প্রচারণা চালানোর বদলে বাংলাদেশের বাস্তব সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তুলে ধরবে। যে সংস্কৃতি বাংলাদেশ যে কোন এক জাতি, এক ধর্ম, বা এক ভাষার দেশ না সেই বাস্তব সামাজিক বৈচিত্র্য তুলে ধরবে। যে সংস্কৃতি হবে সত্যিকারের সংখ্যাগরিষ্ঠের; হবে জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে মেহনতি মানুষের।

সংবিধান সংস্কার বর্তমান বাংলাদেশে একটা আলোচিত প্রসঙ্গ। তা জরুরিও বটে। সেইসাথে এও আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, শুধুই সংবিধানকেন্দ্রিক আলাপ দিয়ে বাস্তবতার বুঝাপড়াটা আসলে সম্পূর্ণ হয় না।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটি চমৎকার সংবিধান আছে। সেই সংবিধানকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, ভারতের শাসক দল বিজেপি বাবরি মসজিদ ভাঙন থেকে গুজরাট গণহত্যা হয়ে আজকের বুলডোজার সন্ত্রাসের কালে এসে পৌঁছেছে। গো-রক্ষার নামে চলছে নিরীহ মুসলিম নিধন।

তাই সংবিধান ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারকামী রাষ্ট্রচিন্তার জরুরত যেমন অস্বীকার করা যায় না, ঠিক তেমন সামাজিক স্তরে মানবিক চিন্তার অনুশীলনের গুরুত্বও উপেক্ষা করা যায় না, দুটোই পাশাপাশি দরকার।

সংস্কৃতি সেই মানবিক চিন্তার অনুশীলনেরই একটি জায়গা। তাই এতে দেশের মানুষের সামাজিক বৈচিত্র‍্যের প্রতিফলন হওয়াই কাম্য, যা গণঅভ্যুত্থানের আগের বাংলাদেশে ছিল অনুপস্থিত । গণঅভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে সেটাই আমাদের সাংস্কৃতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *